কিশোরগঞ্জ জেলার কালনী-কুশিয়ারা নদীর পানি হ্রাস পেয়ে ৬ ইঞ্চির মতো কমেছে। চার দিন ধরে মেঘনা নদীর পানি ভৈরব পয়েন্টে বিপৎসীমার ৫ দশমিক ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে ধনু ঘোড়াউত্রয়া বন্যার পানি প্রবাহিত হয়ে মেঘনা নদীর ভৈরব সেতু দিয়ে নেমে যাওয়ার কথা। সেখানে বিপরীতমুখী তীব্র স্রোতের কারণে পানি নামতে না পেরে ফুঁসে উঠেছে।
এ কারণে জেলার ১১ উপজেলার ৬৫টি ইউনিয়নের এক লাখ ২০ হাজার দুর্গত মানুষ দুুর্ভোগে রয়েছে। তাছাড়া ১১ উপজেলায় প্রায় সাড়ে ১২ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এরমধ্যে ১ লাখ ৭ হাজার ৯৯৮ জন ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ খাদ্য ও বাসস্থানের সমস্যায় আছেন।
বন্যাদুর্গত মানুষের মধ্যে খাদ্যসংকট রয়েছে বলে জানান গভীর হাওরের প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দারা। তাছাড়া ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগের প্রকোট বাড়ছে। দুর্গত মানুষেরা ত্রাণের আশায় ছুটে বেড়াচ্ছেন। নিম্নআয়ের লোকজন দিশেহারা। এ অবস্থায় জেলা ও উপজেলা প্রশাসনসহ স্বেচ্ছসেবী সংগঠনগুলো ত্রাণ তৎপরতা বাড়িয়েছে। তবে, গভীর হাওরের অনেক এলাকায় প্রয়োজনমতো এখনও ত্রাণ পৌঁছায়নি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
মিঠামইন উপজেলার চারিগ্রামের বানেছা বেগম (৫৫), ফুলপুর গ্রামের বাসিন্দা রসুল মিয়া (৫২) বলেন, তাদের এলাকায় দুর্গত মানুষ খাদ্যসংকটে ভুগছে। অনেকেই একবার খেয়ে আছে। ২৪ জুন পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত ৬৬টি মধ্যে ১৫টি পরিবার ত্রাণ পেয়েছে। ৫১টি পরিবার এখনও খাদ্যসহায়তা পায়নি।
একই অবস্থা ইটনা, অষ্টগ্রাম, নিকলী, করিমগঞ্জ, তাড়াইল, বাজিতপুর, অষ্টগ্রাম, কুলিয়ারচরসহ ১০টি উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকার গ্রামগুলোর কয়েক হাজার মানুষের। বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকলেও দিন দিন ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ বেড়েই চলছে।
এবারের বন্যায় সারা জেলায় কয়েক শ মাছের খামার পানিতে মাছ ভেসে যাওয়ায় প্রায় ৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে খামারিরা দাবি করেন। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা রিপন কুমার পাল বৃহস্পতিবার জানান, জেলার ১১টি উপজেলায় ছোট-বড় মাছসহ সব মিলিয়ে ২০ কোটি টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বড় খামারের মালিক করিমগঞ্জের জয়কা ইউনিয়নের পানাহার গ্রামের মৎস্যজীবী সাইদুর রহমান ও নিয়ামতপুর ইউনিয়নের ৮ একর আয়তনের নলুয়া বিলের মৎস্যজীবী পারভেজ মিয়া বলেন, বন্যায় মৎস্যজীবীদের ৫০ কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হয়েছে। সরকারিভাবে আর্থিক সহায়তা না পেলে জেলায় মৎস্যজীবীদের আর্থিক মেরুদন্ড ভেঙে যাওয়ার পাশাপাশি রূপালী মৎস্য সম্পদের জেলায় মাছের খরা দেখা দিবে।
পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ ভয়াবহ বন্যার কারণে কিশোরগঞ্জের হাওর অধ্যুষিত ১৯৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কয়েকদিনের ভারী বর্ষণ, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকার বেশিরভাগ রাস্তাঘাট ডুবে গেছে। পানি উঠেছে বসতবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থানে।
১৯৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সুব্রত কুমার বণিক। অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। ১৪ হাজার ৫৫০ জন মানুষ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের সাথে গুরুত্বপূর্ণ মালামাল এবং গবাদিপশুও রয়েছে।
ভাঙনের ভয়াবহতা কিশোরগঞ্জে হাওরের নিকলী, অষ্টগ্রাম, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম ও বাজিপুরের প্রায় শতাধিক গ্রাম বন্যার পানি ও পাহাড়ি ঢলের পানিতে ভাঙনের কবলে পড়েছে। নিকলী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আবু হাসান জানান, ২৩ জুন বন্যা ও ভাঙনের পরিস্থিতি আরও অবনতি হয়েছে। ছাতিরচর, সিংপুর, দামপাড়া ইউনিয়ন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।
মিঠামইন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, মিঠামইনের ২৫টি গ্রাম ভাঙনের কবলে পড়েছে। লোকজন পাঠিয়ে দেশীয় পদ্ধতিতে গ্রাম রক্ষার কাজ চলছে।
ইটনা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাফিসা আক্তার জানান, এ উপজেলায় ৩৫টি গ্রাম ভাঙনের কবলে পড়েছে। স্থানীয়ভাবে খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে। সরেজমিনে গিয়ে ভাঙন প্রতিরোধে স্থানীয় গাইল পদ্ধতি ব্যবহার করে গ্রামরক্ষা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
পানিবাহিত রোগের প্রর্দুভাব বন্যার কারণে বিভিন্ন এলাকায় ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। এছাড়া বন্যার্তদের মধ্যে পানিবাহিত নানা রোগ দেখা দিয়েছে। তাদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। বন্যার কারণে হাওরে ইউনিয়নে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলো পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় ভ্রাম্যমাণ মেডিকেল টিম আক্রান্তদের সেবা নিশ্চিত করছে। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও প্রবল বর্ষণে সৃষ্ট বন্যায় কিশোরগঞ্জে স্বাস্থ্যসেবায় ১৬৮ সদস্যের মেডিক্যাল টিম গঠন করা হয়েছে।
সিভিল সার্জন ডা. সাইফুল ইসলাম জানান, এই ভয়াবহ বন্যার সময়ে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ১৬৮ সদস্যের মেডিক্যাল টিম জেলার ১৩টি উপজেলায় কাজ করেছে। এর মধ্যে ইটনা উপজেলায় মেডিক্যাল টিমের সংখ্যা ১০ জন, মিঠামইনে ২২ জন, অষ্টগ্রামে ৯ জন, নিকলীতে ৮ জন, তাড়াইলে ৮ জন, করিমগঞ্জে ১২ জন, ভৈরবে ৯ জন, কুলিয়ারচরে ৭ জন, বাজিতপুরে ১২ জন, কিশোরগঞ্জ সদরে ১২ জন, কটিয়াদীতে ৪১ জন, পাকুন্দয়ায় ১১ জন ও হোসেনপুর উপজেলায় ৭ জন।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলম বলেন, বন্যা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং সব ধরনের সমস্যা সমাধানের জন্য বিভাগীয় কর্মকর্তাদের সাথে একাধিক সভা করে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তাছাড়া সরেজমিনে গিয়ে উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সাথে কথা বলা হয়েছে।
Leave a Reply