স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত সিলেট। নগরে ঢুকতে প্রধান যে তিনটি পথ, সেখানে কোমরপানি। সারি সারি বাড়ি যেন নাক উঁচু করে কোনো মতে জানান দিচ্ছে ‘ডুবিনি, এখনো টিকে আছি’। কোনো বাড়ির একতলা পর্যন্ত ডুবে আছে। কোনোটার টিনের চালে পানি। ডুবন্ত সিলেটের বাসিন্দারা একে একে যাচ্ছেন নিরাপদ আশ্রয়ে। মধ্যবিত্তদের অনেকে দূর-দূরান্তে থাকা তাঁদের আত্মীয়স্বজনের বাসায় উঠেছেন। নিম্নবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও হতদরিদ্ররা ঠাঁই নিয়েছেন আশ্রয়কেন্দ্রে।
আশ্রয়কেন্দ্রে সবচেয়ে দুর্বিপাকে আছে শিশু ও বয়স্ক নারীরা। এ ছাড়া অন্তঃসত্ত্বা নারীরা আছেন নানামুখী সংকটে। তবে এসব কেন্দ্রে ডায়রিয়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত কারও কাছে কোনো চিকিৎসা সহায়তা পৌঁছেনি। অন্তঃসত্ত্বাদের জন্য জরুরি চিকিৎসা সহায়তাও মিলছে না। বন্যা পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত ও পানি নামতে দেরি করলে আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা লোকের সংখ্যা বাড়বে। এখনই নজর না দিলে মানবিক সংকটও আরও গভীর হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
নগরীর কিশোরী মোহন আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ১০০ পরিবারের গাদাগাদি বাস। তবে সেখানে ঠাঁই পাওয়া বৃদ্ধ মাজেদা বেগমের গল্পটা আলাদা। পরনে তাঁর ছেঁড়া ফিনফিনে হলুদ শাড়ি। মাজেদার চোখে-মুখে গভীর দুশ্চিন্তার রেখা। বাইরে তখন ঝুম বারিধারা। আশ্রয়কেন্দ্রের জানালার গ্রিল ধরে বাইরে মাজেদার আকুল চাহনি।
তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, মাজেদা দুই ছেলে ও তাঁদের স্ত্রী নিয়ে এখানে উঠেছেন। মাজেদার স্বামী বছর দশেক আগে চলে যান না ফেরার দেশে। তবে এসব কোনো সমস্যা নয়, মাজেদার ভয় সন্তানসম্ভবা দুই ছেলের বউকে নিয়ে। তাঁরা দু’জনই ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। এক বউয়ের নাম আয়েশা, আরেকজন রিপা।
মাজেদা বললেন, ‘ইশকুলে বাচ্চা অয়ে গেলে কী লজ্জা! না আছে এখানে কাপড়চোপড়, না আছে পানি। এই পরিবেশে দুর্ঘটনা ঘটে গেলে কীভাবে সামাল দেব। হাতে এক টাকাও নেই। আজ এক পিস পাউরুটি খাইয়্যা আছি। তিন দিন হয়ে গেল, একমুঠো ভাত খাইতে পারি নাই।’
এরপর মাজেদা যা বললেন, তা শুনে যে কারোর শরীরে দেবে কাঁটা। নগরীর জতরপুর এলাকায় ছিল তাঁদের বাস। হঠাৎ বন্যার পানি চলে আসায় ঘরের কোনো মালপত্র ও পোশাক সঙ্গে আনতে পারেননি। ঘরের ভেতর এসব জিনিস ঠিকঠাক আছে কিনা, তা দেখতে রোববার সাঁতার কেটে প্রায় বাসা পর্যন্ত চলেই গিয়েছিলেন এই বৃদ্ধা। শেষ পর্যন্ত নাকে-মুখে পানি চলে যাওয়ায় তাঁর বাসা পর্যন্ত যাওয়া হয়নি। সাঁতার কেটেই আবার ফেরত আসেন তিনি।
বিভিন্ন এলাকার একাধিক বাসিন্দার অভিযোগ, সিলেট ও সুনামগঞ্জের অধিকাংশ সংসদ সদস্য ঢাকায় বসে দুর্গতদের ব্যাপারে বক্তৃতা, বয়ান ও নানামুখী পরামর্শ দিচ্ছেন। এলাকায় এসে অনেকেই দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াননি। এখন পর্যন্ত বৃহত্তর সিলেটের একজন মন্ত্রী ছাড়া দুর্গতদের দেখতে কেউ এলাকায় আসেননি।
আশ্রয়কেন্দ্রের একাধিক বাসিন্দা বলেন, বিভিন্ন সংগঠন, নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ ও রাজনৈতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় কম।
এদিকে, আশ্রয়কেন্দ্রে দুর্গতদের চিকিৎসাসেবা না পাওয়ার ব্যাপারে অনেকের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সিলেটের সিভিল সার্জন ডা. জন্মেজয় দত্ত বলেন, যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় প্রথম দু’দিন আশ্রয়কেন্দ্রে চিকিৎসকরা পৌঁছাতে পারেননি। রোববার থেকে আমরা কাজ শুরু করেছি। অনেক কেন্দ্রে চিকিৎসকরা যাচ্ছেন।
সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান বলেন, গেল দু’দিন আমরা দুর্গত মানুষকে উদ্ধারে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। এ জন্য ত্রাণ পর্যাপ্তভাবে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এখন ত্রাণ সহায়তার দিকে মনোযোগ দেব। পর্যাপ্ত ত্রাণ আমাদের হাতে রয়েছে।
Leave a Reply