পাগলের মতো ছুটছেন এক তরুণী। ‘আব্বা আব্বা’ বলে কাঁদছেন শিশুর মতো। মর্গের পাশে এসে আর্তনাদ করে বললেন, ‘আব্বা কই, আমার সোনা আব্বা কই?’ কিন্তু কে দেবে কার উত্তর? এই নিদারুণ মুহূর্ত যেখানে, সেখানে অ্যাম্বুলেন্সে একের পর এক সারি বেধে আসছে মরদেহ। স্বজনেরা খুঁজছেন প্রিয়জনের ঝলসানো লাশ।
তরুণীর আহাজারি অনেকক্ষণ ভাসতে থাকে মর্গের বাতাসে, ‘আমার আব্বার চেহারাটা একটু দেখতে চাই। তারে একটু খুঁজে দেন।’
আজ রোববার দুপুরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (চমেক) এই মর্মান্তিক মুহূর্তের সাক্ষী হয়েছেন সমকাল প্রতিবেদক। তিনি জানান, বাবার সন্ধানে চমেক হাসপাতালে আসা ওই তরুণীর নাম ফাতেমা। তিনি মো. ফারুক হোসেনের (৫২) মেয়ে। সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর থেকে তার খোঁজ পায়নি পরিবার। ফারুক ডিপোতে শ্রমিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
ফাতেমার মতো অনেকেই স্বজনের খোঁজে হন্যে হয়ে ছুটছেন চমেকের দরজা থেকে দরজায়। তাদের চোখেমুখে আশা-নিরাশা, বেদনার ছায়া দেখা গেছে। চোখে ম্লান প্রশ্ন, প্রিয় বাবা, ভাই, স্বামী, স্বজনের খোঁজ কি মিলবে? জীবিত নাকি মৃত? ঝলসানো নাকি অঙ্গার?
এদিকে, আজ দুপুর দুইটা পর্যন্ত চমেকে এসেছে ৩৮ জনের মরদেহ। চমেক পুলিশ ফাঁড়ির সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মো. আলাউদ্দিন সমকালকে জানান, নিহতদের মধ্যে পাঁচজন ফায়ার সার্ভিসের কর্মী। আগুন নেভাতে গিয়ে জীবনই নিভে গেছে তাদের। এছাড়া ফায়ার সার্ভিসের অন্তত ২০ জনসহ দেড়শতাধিক লোক আহত হয়েছেন। তাদের অধিকাংশই চমকে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। নিখোঁজ রয়েছেন অনেকে।
স্বজনের সন্ধানে চমেকে এসেছেন তারা/ ছবি– সমকাল
এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বিএম কনটেইনার ডিপোতে এখনো আগুন জ্বলছে। ডিপোতে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে গতকাল শনিবার রাতে। আজ রোববার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ডিপোর মালিক বা কোনো কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে আসেননি। মালিকপক্ষের কেউ না থাকায় কনটেইনার ডিপোতে কী ধরনের কেমিক্যাল রয়েছে, তা জানতে পারছে না ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারী দল।
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাইন উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, মালিকপক্ষের কাউকে না পাওয়াও এখানে কী ধরনের কেমিক্যাল আছে জানা যাচ্ছে না। পানি দিয়ে সব কেমিক্যালের আগুন নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এ কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে সময় লাগছে।
ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে সেনাবাহিনীর প্রায় ২০০ জনের একটি দল। ঘটনাস্থলে থাকা চট্টগ্রাম সেনানিবাসের ইঞ্জিনিয়ারিং কোর ১-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মনিরা সুলতানা সাংবাদিকদের বলেন, কনটেইনার ডিপোটিতে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড রয়েছে। এ কারণে আগুন এখনও নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। আমাদের কেমিক্যাল বিশেষজ্ঞরা ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করছেন।
এ ঘটনায় নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৫০ হাজার করে টাকা ও আহত প্রত্যেক ব্যক্তিকে ২০ হাজার করে টাকা দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। গঠন করা হবে তদন্ত কমিটি। এছাড়া নিহত প্রত্যেক শ্রমিকের পরিবারকে ২ লাখ টাকা এবং আহতদের ৫০ হাজার টাকা করে সহায়তা দেবে সরকার। আহতদের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনে অতিরিক্ত অর্থ দেওয়া হবে। শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিল থেকে এ অর্থসহায়তা দেওয়া হবে।
সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ২৪ একর জায়গাজুড়ে। প্রতিষ্ঠানটি মূলত পণ্য রপ্তানিতে কাজ করে। এখান থেকে পণ্য রপ্তানির জন্য কনটেইনারগুলো প্রস্তুত করে চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠানো হয়। ৩৮ ধরনের পণ্য রপ্তানিতে কাজ করে প্রতিষ্ঠানটি। ঘটনার সময় সেখানে ৫০ হাজার কনটেইনার ছিল বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। অগ্নিকাণ্ডের সময় অন্তত ২০০ শ্রমিক সেখানে কাজ করছিলেন বলেও জানা গেছে। তবে সেখানে ঠিক কত সংখ্যক মানুষ তখন ছিলেন তা এখনো সঠিকভাবে জানা যায়নি।
Leave a Reply