ঈদুল ফিতর উপলক্ষ্যে ঢাকা-বরিশাল নৌ-রুটে বাড়ানো হয়েছে বেসরকারি লঞ্চের ভাড়া। শ্রেণি ভেদে ভাড়া বেড়েছে ৫০ থেকে ৫০০ টাকা। করোনার কারণে গত দুই বছর ঈদুল ফিতরে স্বজনদের কাছে ফিরতে পারেনি কর্মস্থলে থাকা মানুষ। এ বছর করোনার চাপ না থাকায় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহর থেকে লাখ লাখ কর্মজীবী মানুষের ঘরে ফেরার সম্ভাবনাকে পুঁজি করে লঞ্চ ভাড়া বাড়ানোয় যাত্রী ও সচেতন মহলের ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু নিরুপায় হয়ে মানুষ বাড়তি ভাড়া গুনে স্বজনদের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে টিকিট সংগ্রহ করছেন। ঈদ শেষে কর্মস্থলে ফিরতেও একই ভাবে বাড়তি ভাড়া দিতে হবে যাত্রীদের। জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারনে গত বছরের নভেম্বরেও ঢাকা-বরিশাল নৌ-রুটে লঞ্চ ভাড়া বাড়ানো হয়েছিল।
ভাড়া বাড়ানোর বিষয়ে একাধিক লঞ্চ মালিক অবশ্য যুক্তি দেখিয়েছেন বছরের অন্যান্য সময় প্রতিযোগিতার কারণে তারা অনেক কম ভাড়ায় যাত্রী পরিবহন করেন। ঈদের সময় লঞ্চের বাড়তি ব্যয় থাকে। এসব মিটানোর জন্যই কিছুটা বর্ধিত ভাড়া নেওয়া হয়। এখন যেটুকু ভাড়া বাড়ানো হয়েছে তাও সরকারি নির্ধারিত ভাড়ার মধ্যেই আছে। লঞ্চ মালিকরা বলেছেন, ঈদে ঘরে ফেরা এবং কর্মস্থলমুখী যাত্রীদের চাপ কমলেই আবার পূর্বের ভাড়ায় তারা যাত্রী পরিবহন শুরু করবেন।
ঢাকা-বরিশাল নৌপথে চলাচলকারী বিভিন্ন লঞ্চ কোম্পানির কাউন্টার ঘুরে দেখা গেছে, ২৫ এপ্রিলের আগে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এক শয্যার কেবিনের ভাড়া ছিল ১৪০০ টাকা। কিন্তু ২৬ এপ্রিল থেকে ঢাকা প্রান্ত থেকে এই কেবিনের ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ১৬০০ টাকা। এক শয্যার সাধারণ কেবিনের (নন এসি) ভাড়া ১২০০ টাকার স্থলে নেওয়া হচ্ছে ১৪০০ টাকা। দুই শয্যার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কেবিনের ভাড়া ২৪০০ টাকার স্থলে বাড়িয়ে নেওয়া হচ্ছে ২৮০০ টাকা। সাধারণ দুই শয্যার কেবিনের ভাড়াও ২০০ টাকা বাড়িয়ে ২৪০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে।
দ্বিতীয় শ্রেণির সোফার ভাড়া বেড়েছে প্রতি আসনে ১০০ টাকা। ভিআইপি কেবিনের ভাড়া ইচ্ছামত নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। যে লঞ্চ যত বেশি বিলাসবহুল সেই লঞ্চের ভিআইপি কেবিনের ভাড়া তত বেশি। তৃতীয় শ্রেণির (ডেক) যাত্রীদের ভাড়া ঈদ মৌসুমের আগে জনপ্রতি নেওয়া হতো ৩৫০ টাকা। এখন সেই ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ৪০০ টাকা। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, ঈদ শেষে কর্মস্থলে ফিরতেও অনুরূপ বাড়তি ভাড়া গুনতে হবে ঘরে ফেরা বিপুল সংখ্যক যাত্রীদের।
ঈদকে সামনে রেখে লঞ্চ ভাড়া বাড়ানোর বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা-বরিশাল নৌপথে চলাচলকারী লঞ্চ কীর্তনখোলার সত্ত্বাধিকারী মঞ্জুরুল আহসান ফেরদৌস বলেন, প্রতিযোগিতার কারণে বছরের অন্য সময় সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে অনেক কম ভাড়ায় তারা যাত্রী পরিবহন করেন। ঈদের সময় বিশেষ সার্ভিস বা ডবল ট্রিপ দেওয়ার কারণে বরিশালে যাত্রী নামিয়ে খালি লঞ্চ চালিয়ে ঢাকায় গিয়ে যাত্রী আনতে হয়। ফলে জ্বালানি ব্যয় পোষাতে সব শ্রেণির টিকিটে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার মধ্যে রেখেই কিছুটা ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি নেওয়া হয় না।
ঈদকে ঘিরে লঞ্চ ভাড়া বাড়ানোয় ক্ষোভ জানিয়েছেন বরিশাল নৌযাত্রী ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক দেওয়ান আব্দুল রশিদ নিলু। তিনি বলেন, ঈদুল ফিতরে ঘরমুখো মানুষের যাত্রা নিরাপদ ও সুলভ করতে আমরা গত ১৮ এপ্রিল জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে ১২ দফা দাবি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে স্মারকলিপি দিয়েছিলাম। ওই স্মারকলিপির অন্যতম দাবি ছিল বর্ধিত ভাড়া প্রত্যাহার করে পূর্বের ভাড়ায় যাত্রী পরিবহন করার। তা করা হয়নি, বরং আরও ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। এটা যাত্রীদের অসহায়ত্বকে পূঁজি করে পকেট কাটার সামিল। এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন।
সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) বরিশালের সভাপতি অধ্যাপক শাহ সাজেদা বলেন, জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির সময় এক দফা ভাড়া বাড়ানো হয়েছিল। এখন আবার নতুন করে ভাড়া বাড়ানোটা এক ধরনের নিপীড়ন। শাহ সাজেদা বলেন, মানুষের ঘরে ফেরাকে ব্যবসার পূঁজি করা অমানবিক।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল যাত্রী পরিবহন সংস্থার কেন্দ্রীয় সদস্য এবং সুরভী শিপিং লাইন্সের অন্যতম পরিচালক রিয়াজ উল কবির মঙ্গলবার দুপুরে সমকালকে বলেন, ২৮ এপ্রিল বৃহস্পতিবার থেকে ঢাকা-বরিশাল নৌপথে বেসরকারি লঞ্চের বিশেষ সার্ভিস শুরু হবে। এ জন্য লঞ্চ মালিকরা সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছেন। বিশেষ সার্ভিসে ঢাকা প্রান্ত থেকে বৃহস্পতিবার থেকে সোমবার (২ মে) পর্যন্ত সরাসরি ও ভায়াসহ ২৯টি নৌযান বরিশাল তথা দক্ষিণাঞ্চলে যাত্রী পরিবহন করবে।
রিয়াজ উল কবির বলেন, ঈদের সময় যাত্রী চাপ বেড়ে যায়। এ জন্য প্রত্যেক লঞ্চের স্টাফদের সব শ্রেণির যাত্রীদের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার বিষয়ে সতর্ক নজর রাখার জন্য বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তৃতীয় শ্রেণির যাত্রীরা যাতে কোনো ধরনের দুর্ঘটনার শিকার না হন সেজন্য বিশেষ নজরদারি থাকবে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরণী নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিটিএ) যুগ্ম পরিচালক ও বরিশাল নৌবন্দর কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ঈদে ঘরমুখো মানুষের নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বরিশাল নৌবন্দরে। এ জন্য জেলা প্রশাসন, নগর পুলিশ, ফায়ার সার্ভিসের প্রতিনিধি নিয়ে যাত্রী নিরাপত্তায় গঠন করা হয়েছে ‘বন্দর সমন্বয় কমিটি’।
তিনি আরও বলেন, ঈদুল ফিতরের আগে ও পরে মোট ১০ দিন ঢাকা-বরিশাল নৌপথে বাল্কহেড চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যে চ্যানেল ধরে যাত্রীবাহী নৌযানগুলো চলাচল করে ওই চ্যানেলে জেলেরা জাল ফেলতে পারবেন না ওই ১০ দিন।
আসন্ন ঈদুল ফিতর উপলক্ষে সরকারি যাত্রী পরিবহন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ অভ্যন্তরীন নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিটিসি) ঢাকা-বরিশাল তথা দক্ষিণাঞ্চলের নৌরুটে বাড়তি কোন জাহাজ দিতে পারছে না। বিআইডব্লিটিসি’র বরিশালের উপব্যবস্থাপক কে এম এমরান মঙ্গলবার বলেন, ঈদ উপলক্ষে ঢাকা-বরিশাল-মোড়েলগঞ্জ রুটে সার্ভিসে থাকা বিআইডব্লিটিসির জাহাজ এমভি মধুমতি ও এমভি বাঙালি এই রুটে প্রতিদিন যাত্রী পরিবহন করবে। এই দুটি স্টীমার সাধারণ সময় ঢাকা-বরিশাল-মোড়েলগঞ্জ রুটে সপ্তাহে দু’দিন যাত্রী সেবা দিত।
কে এম এমরান বলেন, ঢাকা প্রান্ত থেকে ২৭ এপ্রিল থেকে ৫ মে পর্যন্ত টানা ৯ দিন এবং মোড়েলগঞ্জ প্রান্ত থেকে ২৮ এপ্রিল থেকে ৭ মে পর্যন্ত ১০ দিন যাত্রী সেবায় প্রতিদিন নিয়োজিত থাকবে মধুমতি ও বাঙালি।
Leave a Reply