নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মেঘনায় মাছ ধরতে গিয়ে নৌপুলিশের গুলিতে নিহত জেলে আমির হোসেনের বাড়িতে চলছে মাতম। অল্প বয়সে স্বামীকে হারিয়ে এখন নিঃস্ব স্ত্রী সুরভী বেগম। ৩ বছর বয়সী প্রতিবন্ধী ছেলে আসিব এখন এতিম। আর শেষ বয়সে বেঁচে থাকার একমাত্র ভরসা ছেলেকে হারিয়ে দিশেহারা বাবা মতলব রাঢ়ী ও মা ছকিনা বিবি।
দুই মাসের চলমান নিষেধাজ্ঞার মধ্যে আমিরসহ ১০ সঙ্গী শনিবারর রাতে মেঘনায় মাছ ধরতে গিয়ে লক্ষ্মীপুরের নৌপুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হন। রোববার সকালে ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আমির। এ খবরের পর থেকেই পুরো গ্রামে নেমে আসে শোকের ছায়া।
সোমবার আমিরের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের। মেঘনার তীরঘেঁষা বাড়িতে চলছে স্বজন হারানোর বিলাপ। প্রায় বিধ্বস্ত ঘরের আঙিনায় বসে আমিরের স্ত্রী সুরভী বেগম আর্তনাত করে বলেছেন, ‘এ বয়সে আমি কেন বিধবা হইছি, আমার পোলা কেন এতিম হইছে? আমি তার জবাব চাই। যারা আমার স্বামীকে খুন করছে আমি তাগে বিচার চাই।’
বার বার মূর্ছা যাচ্ছেন আমিরের বাবা মতলব
স্বামী হত্যার বিচারের দাবি জানিয়ে বিলাপ করতে করতে মূর্ছা যান সদ্য স্বামীহারা জেলেবধূ সুরভী বেগম। জ্ঞান ফিরে পেলে আবারও বিলাপ করতে করতে জ্ঞান হারান। যেটুকু সময় জ্ঞান থাকে তখন উপস্থিত শত শত গ্রামবাসীর কাছে আকুতি জানান, আমনেরা কন আমি কীভাবে বাঁচমু, আমার প্রতিবন্ধী পোলা কী খাইয়া বাঁচব। আমার বুড়া শ্বশুর-শাশুড়ির খাওন কে দিব?
এমন আকুতি করতে করতে সুরভীর ২ দিন কেটেছে। স্বামীর মৃত্যুর শোকে চিৎকার করতে করতে গলা দিয়ে এখন আর শব্দ বের হচ্ছে না। তবুও থামছে না সুরভীর বিলাপ। মেঘনা পাড়ের ছোট বাড়ির সেই বিলাপ ছড়িয়ে পড়েছে পুরো চরমোহাম্মদ আলী গ্রামে। শত শত প্রতিবেশী নারী-পুরুষের সববেদনাও স্বামীহারা সুরভীকে সান্ত্বনা দিতে পারেনি।
সুরভীর পাশে বসেই অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন তার শ্বাশুড়ি ছকিনা বেগম। ছেলের মৃত্যুর শোকে বাকহীন ছকিনা বেগম। তিনি রোববার সকাল থেকেই না খেয়ে ছেলের লাশের অপেক্ষা করছেন বাড়ির উঠানে বসে আছেন। সোমবার সকালে ছেলে লাশ দাফন হয়েছে কিন্তু তারপরও ঘরে ঢুকেননি তিনি।
মাত্র ২৫ বছর বয়সী ছেলের এমন মৃত্যু কোনোভাবে মেনে নিতে পারছেন না ছকিনা বেগম। ছেলে আমিরের বিষয়ে জানতে চাইলে, কান্না শুরু করেন তিনি। দীর্ঘ সময় পর কান্না থামিয়ে বলেন, ‘পোলা আমার লাইগ্যা ইফতারি লইয়া আওয়ার কথা। সেই পোলারে খুন করছে। অহন আমারে ভাত খাওয়াইব কে? আল্লাহ কেন খুনির বিচার করে না। পোলা আমার খাইট্টা খাইত। চুরি-ডাহাতে করতো না। বাহিনী তারে কিয়ারে গুলি কইলা মাবর? অহন আমি কি করমু?’
ছেলের দাফন শেষে বাড়ি ফিরে ঘরের পেছনের মেঘনার তীরে গিয়ে একা বসে রয়েছেন বাবা মতলব রাঢ়ী। দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ মতলব ঠিকমতো হাঁটতে পারেন না। চৈত্রের এই তীব্র তাপদাহেও গায়ে চাঁদর জড়িয়ে কাপুনি কমানোর চেষ্টা করছেন। কথা বলার শক্তি নাই। ছেলের সম্পর্কে জানতে চাইলে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকেন তিনি। চোখের পানি গালবেয়ে নিচে পড়ে কিন্তু মুখ ফুটে কথা বের হয়নি ছেলেহারা মতলবের।
জানা যায়, রোববার মধ্যরাতে ঢাকা থেকে আমিরের লাশ ভোলার রাজাপুরে আনা হয়। বাড়ি যাওয়ার রাস্তা খারাপ হওয়ায় সকালে পাশের জনতাবাজার মসজিদে জানাজা শেষে মামার বাড়ির গোরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, চরমোহাম্মদ আলী গ্রামের উত্তরের সর্বশেষ বাড়িটি আমিরের বাবা মতলব রাঢ়ীর। তার ঘর থেকে মেঘনাতীর মাত্র ২০০ গজ। গত বর্ষার জোয়াড়ে বাড়ির ২টি ঘর বিধ্বস্ত করে রেখে গেছে। যা এখনও সংস্কার করা হয়নি। বাড়ির উত্তর ভিটার ঘরটিতে ছোট ছেলে আমিরকে নিয়ে মতলব রাঢ়ীর বসবাস। দক্ষিণ ভিটার ঘরে বড় ছেলে জামাল পরিবার নিয়ে থাকে।
৩ ছেলের আরেকজন কামাল পাশের বাড়িতে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বসবাস করেন। শনিবার রাতে আমিরের সঙ্গে একই ট্রলারে বড় ভাই কামালও নদীতে গিয়েছিলেন মাছ ধরতে। নৌপুলিশের সঙ্গে সহিংসতায় আমির নিহত হন। আর কামালকে আহত অবস্থায় পুলিশ জেলহাজতে পাঠিয়েছেন। এ ঘটনায় বৃদ্ধ মতলব এক ছেলেকে চিরতরে হারিয়েছেন। জেলখানায় থাকা অন্য জেলেকে ছাড়িয়ে আনার তৌফিক নেই। এই শোকেই তিনি কাতর।
জানা যায়, আমিরের জেলেকার্ড ছিল না। সে কারণে সরকারি কোনো সহায়তাও তিনি পাননি। নিষেধাজ্ঞার কারণে কর্মহীন থাকায় সংসারে চরম অভাব অনটন দেখা দিয়েছে। ১০ দিন আগে একবার মেঘনায় মাছ ধরতে গিয়ে নৌপুলিশের হাতে আটক হন আমিরসহ তার অন্য সঙ্গীরা। সে সময় ৭০ হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে ছাড়া পায় আমিরের ট্রলার। কথা ছিল মাছ ধরতে আর বাধা দেবে না তারা। সেই আশ্বাসে নদীতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত প্রাণ হারাতে হলো আমিরকে।
উল্লেখ্য, শনিবার রাতে মেঘনায় মাছ ধরতে যায় ভোলা সদর উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের জোরখাল ঘাটের মনির চৌকিদারের ট্রলারের ১১ মাঝি-মাল্লা। এরমধ্যে চর মোহাম্মদ আলী গ্রামের আমির হোসেন ও তার ভাই কামালও ছিলেন। জাল ফেলে অপেক্ষা করার অবস্থায় ভাটির টানে ট্রলারটি ভোলার সীমানা ছড়িয়ে লক্ষ্মীপুরের জলসীমানায় ঢুকে যায়।
ওই সময় বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জের কালিগঞ্জ এলাকার জেলেদের সঙ্গে লক্ষ্মীপুরের নৌপুলিশের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। কালিগঞ্জের জেলেরা পালিয়ে গেলেও বিপদে পড়ে ভোলার মনির চৌকিদারের ট্রালারটি। নৌপুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হন আমির হোসেন। আহত হন ৪ পুলিশসহ ১৫ জন। আটক হন আমিরের ভাই কামালসহ ট্রলারের সব জেলে। পরদিন রোববার সকাল সাড়ে ৭টায় ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আমিরের মৃত্যু হয়।
Leave a Reply